২১ শে ফেব্রুয়ারী ২০২১, ভোর ৪:৪৫ মিনিটের আশেপাশে যখন ঘড়ির কাটা তখন বিকট এক শব্দ ও দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার শব্দসহ অর্ধ-জ্ঞান অবস্থায় কানে ভেসে আসে Md. Imran Khan ভাই এর ডাক।তার ডাক শুনে পুরোপুরি হিতাহিত জ্ঞান যখন আমার আসে চোখ মেলে দেখি এ এক অন্য দুনিয়া,যার জন্য কখনই প্রস্তুত ছিলাম না এবং আশাও করিনি।
২০ তারিখ রাত ৭:৪০, বাসা থেকে বের হই আব্বু আম্মুকে বলে, আম্মু ‘আল্লাহ হাওলা,বলে বিদায় দেয়।আমি যথারীতি আয়তুল কুরসি ও কয়েকটা দোয়া পরে বের হই। ভাইয়ের বাসায় আসার পর রাত ৮:০০ তখনও আমি সহ ইমরান ভাই কনফিউজড যে আমরা কোথায় যাবো? বগুড়া’ই নাকি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে রাজশাহী বা সিলেটের কোথাও যাবো? কারন, যখন জানতে পারি রবিবার হওয়ায় সাথে ২১শে ফেব্রুয়ারী হওয়ায় মহাস্থানগড় বন্ধ থাকবে (ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী)। পরবর্তীতে ইমরান ভাই সহ রাত ৯ টায় বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি সিলেটের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পরবর্তীতে আবারও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই উত্তরবঙ্গের দিকেই যাবো। শনিআখরা থেকে বাসে উঠে পড়ি কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ইতোমধ্যে জয় ভাইয়ের কাছ থেকে শিওর হয়ে নেই যে আসলেই মহাস্থানগড় বন্ধ থাকবে। তখন বাসে থাকা অবস্থায় ইমরান ভাই বলে যে বগুড়া যাবো নাকি পুরান ঢাকার কাচ্চি খেয়ে বাসায় যাবো? না থাক আগে কল্যাণপুর যেয়ে নেই। জ্যাম থাকায় কল্যাণপুর পৌঁছাই রাত ১০:৩০ মিনিটের কিছু পর। গিয়ে দেখি ১১:২০ এর গাড়ি। ২ টি সিট দিতে বলায় কাউন্টার থেকে সিট পছন্দ করতে বলে, আমি ৬ নং সারির ৩,৪ সিলেক্ট করলাম। ছোট থেকেই শুনে আসছি আমার নানা(মৃত) আমার আম্মুকে উপদেশ দিতো যে গাড়িতে উঠার সময় সবসময় মাঝখানের সিটে বসতে,সেই বিষয়টা কেনো যেন সেদিন আমার মাথায় বারবার আসছিলো আর সেই চিন্তা থেকে মাঝের সিট বরাদ্দ করি। হাতে কিছু সময় থাকায় ভাই বললো এখানেই হালকা কিছু খেয়ে নেই চল।যদিও বাসা থেকে দুজনেই খেয়ে আসছি। হোটেলে গিয়ে হালকা খাওয়া সেরে কাউন্টারে এসে বসে ছিলাম,বাস আসার পর বাসে ওঠি “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” ও “আল্লাহু আকবর” বলে। বাস ছাড়ে রাত ১১:৩৬, ছাড়ার সাথে সাথে বিসমিল্লাহ বলে নেই (অভ্যাসগত)।
মোটামুটি সঠিক ভাবে চলছিলো বাস। যমুনা সেতুর পূর্ব পাশের আগে (রাত ২:১৫) পোঁছানোর পর আমি সিট থেকে উঠে বাসের সামনে গিয়ে হেল্পার, সুপারভাইজার এর সাথে খোস গল্প করি সেতু পার হওয়া পর্যন্ত। এরমধ্যে গল্পের বিষয়ছিলো আমরা আনুমানিক কি সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারবো, জ্যাম এর সম্ভাবনা কেমন, তারা রাতে খেয়েছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সেতু পার হওয়ার পর আমি সিটে চলে আসি এবং কিছুটা ঘুমানোর চেষ্টা করি কিন্তু কোনভাবেই ঘুম আসছিলো না,এরপর আমি ঘুমানোর সময় যে ছোট ইবাদত গুলো করি তা করা শুরু করলাম। ঘুমে চোখ লাগার আগ পর্যন্ত আমার মনে আছে আমি আস্তাগফিরুল্লাহ,আস্তাগফিরুল্লাহ জপতেসিলাম। হালকা ঘুম ভেঙে যায় আনুমানিক রাত ৩:৪৫ এর দিকে যখন হোটেল বিরতি দেয়। বিরতি শেষে বাস বের হয় ৪:২০ এর দিকে (ঘুমের মধ্যে আবছা চোখে নিজের ঘড়িতে দেখা)।বাস চলা শুরু করে কিন্তু আমি সহ ইমরান ভাইও ঘুমাচ্ছিলো।
হঠাৎ করে গ্লাস ভাঙার সহ বিকট শব্দ শুনতে পাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কিছু ওলট পালট। নিজেকে আবিষ্কার করি আমার সামনে থাকা ভেঙ্গে যাওয়া সিটের উপর। নিজের চশমাটা নিখোঁজ হয়ে যায়, ফলে স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না সব ধোঁয়াশা। আমি ছিলাম ৬ নং সিরিয়ালে। আমার সামনে থাকা ১ম থেকে ৫ নং সিরিয়ালের সবগুলো সিট ভেঙে উঠে যায় এবং সব একসাথে জড় হয়ে আছে। ঘটনাটি সর্বোচ্চ ৫ সেকেন্ডের কিন্তু তা হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর একটি ঘটনা। ভিতর থেকে অনেকেরই কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে দেখি ইমরান ভাই গুরুতর ভাবে আহত। মাথায় কেটে যাওয়ার ফলে ব্লিডিং হচ্ছিলো।পায়ের হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা পায়। ভাইকে আগে বসতে দিয়ে নিজের রাখা পানির বোতল খুজতে যাই কারন ভাই পানি চাচ্ছিলো,ব্যাগটি পাচ্ছিলাম না কোথায় যে গিয়ে পড়েছে তার খোঁজ নেই।তবে পানির বোতল খুঁজতে গিয়ে অনেক নিথর দেহ দেখি যেগুলো কিছুক্ষণ আগেও গন্তব্যে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কয়েকজন নিজের সিটে থাকা অবস্থায়ই প্রানত্যাগ করে,এবং সেই অবস্থায়ই দেহটি পড়ে আছে। পাথর-বোঝাই ট্রাক এবং বাসের সম্মুখ সংঘর্ষের ফলে ট্রাক সরাসরি বাসে আঘাত করে চালকের আসন সহ প্রথম ৩ সারির সিট নিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। এতে বুঝাই যাচ্ছে সামনে থাকা যাত্রীদের কি অবস্থা। মোটামুটি ২০ মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে চলে আসে এবং আহতদের উদ্ধার করে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করেন।সর্বশেষ আমরা বের হই। উদ্ধারকর্মীরা ভাইকে বাহিরে বের করার জন্য পথ তৈরি করতে গিয়ে অনেক প্রানহীন দেহ সরাচ্ছিলো, তা দেখে কখনো ভুলবার নয়।আর প্রত্যেকটা সিটেই ছড়িয়ে ছিলো প্রচুর *ক্ত। বের হওয়ার সময় অনেক সামনে দেখি আমার ব্যাগটি পরে আছে, লেগে আছে কারো না কারো *ক্ত। পুরো বেঁকে থাকা দরজা দিয়ে বের হয়ে দেখি বাস থেকে আনুমানিক ২০ ফুট দূরে ও ৩০ ফুট দূরে ড্রাইভারের সাথে থাকা দুজনের রক্তাক্ত নিথর দেহ। খুব খারাপ লাগলো এই ভেবে যে কিছুক্ষণ আগেও যাদের সাথে কথা বলছিলাম তারাই এখন লাশ। বেশি আহতদের উদ্ধারকর্মীরা গাড়িতে তুলে হসপিটালে নিয়ে যায়। আমরা পরের বাসে উঠে বসি। পরে তারা আমাদের হসপিটালের সামনে নামিয়ে দেয়। ভাইয়ের প্রাথমিক চিকিৎসা সহ এক্স-রে করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ কোনো সমস্যা ধরা না পড়ায় আমরা দুপুরে (১:৩০) ঢাকা ব্যাক করি এবং রাতে (৮:৩০) বাসায় পৌঁছাই।
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় এই ভেবে যে এতবড় ভয়ংকর একটা দূর্ঘটনা থেকে আল্লাহ আমাকে হেফাজত করেছে (আলহামদুলিল্লাহ)। দুই হাঁটুতে ব্যাথা লাগে এক হাঁটুতে হালকা কেঁটে যায়, আরেক পায়ে কয়েক যায়গায় কেঁটে যায়।রাতের দিকে বুঝতে পারি দুই হাতের কব্জি মাথায়ও কিছুটা আঘাত লাগে যার ফলে ব্যাথা হচ্ছিলো। কিন্তু আমি এইটা মিলাতে পারছিনা যে আমার বেল্ট কোমরের পিছন দিক থেকে ছিড়ে গেছে অথচ আমি বুঝতেই পারিনি। হয়তো এটা আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত ছিলো আমার জন্য। না হয় আমি এতোটা সুস্থ থাকতে পারতাম না এই দূর্ঘটনায়। আল্লাহ সবকিছু ভালো জানেন এবং বুঝেন এটাই হলো বড় কথা, আল্লাহ সর্বশক্তিমান।
সবাইকে একটা অনুরোধ করবো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি ছোট ছোট ইবাদত গুলো পালন করার চেষ্টা করবেন। হয়তো আল্লাহ এই ছোট ইবাদত গুলোর জন্য অনেক বড় বড় সমস্যা থেকে রক্ষা করবেন।আর অবশ্যই বাবা-মা এর দোয়া নেওয়ার চেষ্টা করবেন,বাবা মা এর দোয়া থাকলে কোন সমস্যা আপনার কাছে সমস্যা মনে হবে না আল্লাহ সহজ করে দিবেন।। সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য। আল্লাহ হাফেজ।
© All rights reserved © 2020 bd-bangla24.com